প্রকাশিত: Mon, May 6, 2024 1:17 PM
আপডেট: Sun, Jun 22, 2025 8:15 PM

লংগদু গণহত্যার বিস্তারিত বর্ণনা আরেকবার লিখতে পারবো না!

ইমতিয়াজ মাহমুদ : [ ১] রাঙ্গামাটি থেকে শরমিতা ম্যাসেজ পাঠিয়েছে, ‘ভাইয়া, ৪ মে লংগদুর গণহত্যা দিবস। ভোরবেলা আমি সঙ্ঘদান অষ্টপুরস্কার দান করব। মাকে মনে পড়ছে।’ তখন বেশ রাত, জেনিফার ড্রেসিং পাল্টে দিতে হবে, ডেসিং সরঞ্জাম শেষ হয়ে গেছে, আমি বেরিয়েছি রিক্সা নিয়ে ওষুধের দোকান কোনটা খোলা আছে সেটা খুঁজতে। আমার বুকের ভেতর তোলপাড় করে ওঠে ১৯৮৯ সালের ৫ মে’র লংগদু গণহত্যার কথা। ওর মায়ের মৃত্যুর কথা। শহরে প্রচণ্ড গরম, শুক্রবার গভীর রাতে রাস্তায় মানুষজন নাই। আমি সবুজ লুঙ্গি আর সাদা ফিনফিনে পাঞ্জাবি পরে বেরিয়েছি, আমি ম্যাসেজ দেখি আর রিক্সায় বসে নীরবে কাঁদতে থাকি। আমাদের পাহাড়ে বেশ কয়েকটি গণহত্যার ঘটনা আছে যেখানে বাঙালি সেটেলার বা সরকারি বাহিনীর হাতে প্রাণ হারিয়েছে অসংখ্য আদিবাসী মানুষ, নিঃস্ব হয়েছে অনেক পরিবার, ধ্বংস হয়েছে বাড়িঘর। এইসব গণহত্যার বর্ণনা যখন আমরা করি তখন সাধারণত সামগ্রিক ঘটনা ও অসংখ্য মানুষের সংশ্লিষ্টতার মধ্যে হারিয়ে যায় একেজন ব্যক্তি বা একেকটি পরিবারের নিজস্ব ত্যাগ কষ্ট ও দুঃখের কথা। কিছু আহত নিহতের সংখ্যা যখন আমরা বলি, অনেক সময় মনে থাকে না যে সংখ্যাগুলি হচ্ছে মানুষের সমষ্টি আর প্রতিটা আহত বা নিহত মানুষের মৃত্যুই একেকটা স্বতন্ত্র গল্প, স্বতন্ত্র শোকগাঁথা। 

লংগদু গণহত্যার ঘটনাটি ঘটেছে ১৯৮৯ সনে, এরশাদের সময়। তিনদিন ধরে ধ্বংসযজ্ঞ চালায় সশস্ত্র ভিডিপি আর বাঙালি সেটেলাররা, তিনদিন ধরে চলা সেটেলারদের হামলায় আক্রান্ত হয়েছিল নয়টি গ্রাম। কতজনের মৃত্যু হয়েছিল সেদিন সেই সংখ্যা নিশ্চিত কেউ জানে না। একটা রিপোর্টে ৩৬ জনের নাম পরিচয় পাওয়া গেছে, সর্বমোট সংখ্যা সম্ভবত পঞ্চাশেরও বেশি হবে। আহতের সংখ্যা অগুণতি, ধ্বংস হয়েছে কয়েকশ ঘরবাড়ি, ওরা ধ্বংস করেছে বৌদ্ধ বিহার, স্কুল, গির্জা। কয়েক হাজার মানুষ সেবার আতঙ্কে লংগদু ছেড়ে সীমান্ত পারি দিয়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। এই ব্রহ্মত্ব চিত্রটির মধ্যে থেকে আমাদের শরমিতার পরিবারের ঘটনাটি যদি আপনি দেখেন, তাইলে আঁতকে উঠবেন।

[২] শরমিতার বাবা অনিল বিহারী চাকমা ছিলেন লংগদু সদরের হেডম্যান, প্রাক্তন ইউপি চেয়ারম্যান, একজন জনপ্রিয় ট্র্যাডিশনাল লিডার। উপজেলা সদরেই তিনটিলা গ্রামে ওদের বাড়ি। চার তারিখে সন্ধ্যার দিকে যখন ভিডিপি সেটেলাররা মিলে আক্রমণ শুরু করে, শুরুতেই ওরা আক্রমণ করে তিনটিলা গ্রামে। আক্রমণের প্রথম দিকে সারা গ্রাম থেকে অনেকেই অনিল বিহারী চাকমার বাড়ীতে এসে আশ্রয় নিয়েছিল। সশস্ত্র ভিডিপি আর সেটেলাররা দলবেঁধে আক্রমণের সুড়তেই সেখানে গুলি ছুড়তে থাকে, পরে ঘরের মধ্যে ঢুকে সামনে যাকে পেয়েছে তাকেই হত্যার চেষ্টা করে, ওদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি ছোট শিশুরাও। শরমিতার মা অমিতা চাকমার বয়স তখন ৪০শের মতো। অসম্ভব সুন্দরী আর নাটক সিনেমায় মমতাময়ী মা বলতে যেরকম দেখায় একদম সেরকম- স্নিগ্ধ স্নেহময়ী। 

ঘাতকের প্রথমে তাঁকে রাইফেল থেকে গুলি করে। এরপর আহত মাকে ওরা বল্লম, তলোয়ার এইরকম ধারালো অস্ত্র দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। সেই বাড়িতেই ওরা হত্যা করে নয় বছরের শিশু সজল চাকমাকে, তিন বছরের একটি শিশু কন্যাকে। অনিল বিকাশ চাকমা একরকম অলৌকিকভাবেই প্রাণে বেঁচে যান। তিনি তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রীর মৃতদেহ নিয়ে বাড়ির পেছন দিকে জঙ্গলে লুকিয়ে থাকেন সারারাত। সকালে যখন তিনি মৃতদেহ রেখে লোকজনকে খবর দিতে বাইরে যান, ফিরে এসে তাঁর স্ত্রীর মৃতদেহ তিনি আর খুঁজে পাননি। অনিল বিহারী চাকমার বাড়ীতেই সেদিন বাঙালীদের আক্রমণে মৃত্যু হয় নয়জন বা দশজনের। এটা চার তারিখের ঘটনা। তিন্তিলা থেকে ওরা আশেপাশের অন্যান্য গ্রামে যায়, এইভাবে নয়টা গ্রামে তিনদিন ধরে পাহাড়িদের বাড়িঘর প্রার্থনার ঘর, স্কুল সব জায়গাতেই হামলা হয়। ধ্বংসলীলা চলতে থাকে, সেখানে আর্মি ছিল, বিডিআর ছিল, পুলিস ছিল, কেউ বাধা দেয়নি। বরং অভিযোগ আছে, একদম সেনাবাহিনীর অফিসারদের নাম উল্লেখ ক্রে অভিযোগ আছে, যে সরকারি বাহিনীগুলি এই ঘটনায় মদদ জুগিয়েছে। 

[৩] লংগদুর এই ঘটনার কথা আমি এর আগেও ফেসবুকে লিখেছি। এবারও হয়তো লিখতাম বিস্তারিত, কিন্তু শরমিতার ম্যাসেজ পেয়ে আর আমি ফেসবুকে গুছিয়ে কিছু লিখতে পারছি না। এই মেয়েটা সেদিন নিতান্ত একটি শিশু ছিল। এই ঘটনায় সে তাঁর মাকে হারিয়েছে, স্বজন হারিয়েছে। প্রতিবছর মে মাস আসে আর ওর মনের মধ্যে কী যন্ত্রণা কষ্টের স্রোত বয়ে যায় সে কি আপনি কল্পনা করতে পারেন? আমি পারি না। আমি কল্পনাও করতে পারি না যদি এইরকম স্মৃতি নিয়ে আমাকে বেঁচে থাকতে হতো তাইলে কি আমি স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারতাম? 

আমরা এইরকম অনেক গণহত্যা বা সেরকম ঘটনার কথা বলি, কিন্তু এইসব বড় ঘটনার মধ্যে যেসব ব্যক্তি ও পরিবারের শোকের স্মৃতি থাকে সেগুলি কথা আর লক্ষ্য রাখি না। আমাদের কি উচিত ছিল না এই ঘটনাটির পর অন্তত একটা স্পষ্ট তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা? সেটা তো আমরা করিনি। চাকমা সার্কেলের রাজা ও পাহাড়ের অন্য কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি সেসময়ের প্রেসিডেন্টের কাছে একটা আবেদন করেছিলেন, একটা বিচার বিভাগীয় তদন্ত হোক, দোষীদের চিহ্নিত করা হোক। সেইসব কিছু তো হয়ইনি, উল্টো রাজাবাবুকে কিছুদিন ওরা গৃহবন্দি করে রেখেছিল। এখন এইসব ইতিহাস বললে অনেকে রেগে যায়, ধমক দেয়, গালাগালি করে। 

না, লংগদু গণহত্যার বিস্তারিত বর্ণনা আমি আরেকবার লিখতে পারব না। আমার কেবল মনে হচ্ছে, এই যে পরিবারগুলি, শ্রমীটার মতো বাচ্চারা যারা এইসব স্মৃতি নিয়ে বড় হয়েছে, ওদের সামনে আমরা কি মুখ নিয়ে দাঁড়াবো? আমার এই বোনটির কষ্টের কথা কি আপনি আমি কোনোদিন সম্পূর্ণ অনুধাবন করতে পারব? পারব না। গত সংসদে এমপি ছিলেন বাসন্তী চাকমা। বেচারা সংসদে এক বক্তৃতায় পানছরি গণহত্যার সময় নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলেছিল। ওকে সেটেলাররা যেভাবে গালাগালি হুমকি দিয়েছে সে তো আমি দেখেছি। কাদের চাপে জানি না, বাসন্তী চাকমাকে পরে ক্ষমা চাইতে হয়েছে, সত্যি কথা বলার অপরাধে ক্ষমা চেয়েছে মেয়েটা। 

[৪] কী লিখব আমি? শরমিতার মায়ের হত্যার বিচার হবে লিখব? আপনারা বলুন। আপনারা ওর জীবনের সেইসব দিন ফিরিয়ে দিতে পারবেন? পারবেন না। অন্তত এইটুকু তো আমরা স্বীকার করতে পারতাম যে না, ওদের সাথে অন্যায় হয়েছে, অপরাধ হয়েছে। সেইটাও করিনি। কী লিখব আমি। কী লিখব আমি আমার এই বোনটির জন্য? আপনারাই বলে দিন। লেখক: আইনজীবী। ফেসবুক থেকে